নবীনগরে সন্ত্রাস, দুর্ঘটনা ও চুরির ঘটনা: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রশ্নবিদ্ধ চিত্র
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলা, একটি জনবহুল এবং প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, বর্তমানে একাধিক নৈরাজ্যকর ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে। গতকালের (৭-৮ এপ্রিল ২০২৫) বিভিন্ন ঘটনা নবীনগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অপহরণ, সড়ক দুর্ঘটনা এবং চুরির মতো ঘটনা যেখানে একদিনের ব্যবধানে ঘটে, সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে।
অপহরণ নাটক: ডিজিএফআই পরিচয়ে সন্ত্রাস
নবীনগর উপজেলার লাউর ফতেহপুর গ্রামে ৭ এপ্রিল রাতে ঘটেছে এক চাঞ্চল্যকর অপহরণ ঘটনা। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিজেদেরকে গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর (ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরসেস ইন্টেলিজেন্স) সদস্য পরিচয় দিয়ে শহিদুল ইসলাম মালু মিয়ার বাড়িতে প্রবেশ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল শহিদুলের ছেলে রিফাত মিয়াকে অপহরণ করা এবং মুক্তিপণ আদায়।
চক্রটি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি ঘিরে ফেলে, রিফাতকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তারা মোবাইল ফোনে পরিবারকে জানায়, রিফাত তাদের হেফাজতে এবং তাকে মুক্ত করতে হলে এক কোটি টাকা দিতে হবে। পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বিষয়টি নবীনগর থানাকে অবহিত করলে পুলিশ দ্রুত অভিযান শুরু করে। পরবর্তীতে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযানে নেমে অপহরণকারী চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় এবং অপহৃত রিফাতকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে।
গ্রেফতার হওয়া অপরাধীদের মধ্যে কয়েকজন রাজধানী ঢাকা ও গাজীপুরের বাসিন্দা। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে খেলনা পিস্তল, হ্যান্ডকাফ, আইডি কার্ড ও ডিজিএফআইয়ের নকল ইউনিফর্ম। এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করেই তারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে অপহরণ ও চাঁদাবাজি করে আসছিল।
এই ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ও অদক্ষতা যেমন প্রমাণ করে, তেমনি সাধারণ মানুষের মনে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের প্রতি ভয় এবং অনিরাপত্তা অনুভব আরও জোরদার করে তুলেছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি: দীর্ঘদিনের সমস্যা এখনো অব্যাহত
অন্যদিকে, ৮ এপ্রিল সকালে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের রামরাইল এলাকায় ঘটে আরেকটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। একটি লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই দুজন যাত্রী নিহত হন এবং আরও চারজন গুরুতর আহত হন।
নিহতরা হলেন নবীনগর উপজেলার নজরদৌলত গ্রামের তানভীর মিয়া (২৩) ও আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম (২৫)। তারা স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন এবং প্রতিদিনের মতো কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন।
পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনাকবলিত লরিটি চালাচ্ছিলেন একজন অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক। তাছাড়া মহাসড়কে চলমান অতিরিক্ত মালবাহী গাড়ির চাপ এবং ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা এমন দুর্ঘটনার হার দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, সড়কে পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ নেই, নেই গতিবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, ফলে চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। এমনকি দুর্ঘটনার পরে আহতদের হাসপাতালে নিতে যথেষ্ট বিলম্ব ঘটে, যা অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রাতের আঁধারে দোকানে চুরি: চোরচক্রের সাহসী তৎপরতা
সেই রাতেই নবীনগর উপজেলার শ্রীরামপুর পূর্বপাড়া কাঠের ব্রিজ সংলগ্ন একটি দোকানে ঘটে আরেকটি অপ্রীতিকর ঘটনা। হাফিজ স্টোর নামের ওই দোকানে গভীর রাতে চোরেরা টিন কেটে প্রবেশ করে নগদ টাকা ও মূল্যবান পণ্য চুরি করে নেয়। দোকানের মালিক জানান, চোরেরা দোকান থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মালামাল ও টাকা নিয়ে গেছে।
এই ঘটনায় এখনো কোনো সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা যায়নি। স্থানীয় জনগণ এবং ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, পুলিশি টহল থাকলেও রাত গভীর হলে অনেক সময় তা অনুপস্থিত থাকে, আর তখনই চোরচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে।
নবীনগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তবতা
এই তিনটি ঘটনা – অপহরণ, সড়ক দুর্ঘটনা ও চুরি – যেন নবীনগরের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতির একটি চিত্র তুলে ধরে। যেখানে দিনে ঘটে দুর্ঘটনা, রাতে অপহরণ ও চুরি; সেখানে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করা কতটা কঠিন তা সহজেই অনুমেয়।
এই উপজেলায় বর্তমানে সুশাসন ও কার্যকর প্রশাসনিক নজরদারির প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে, নিয়মিত পুলিশি টহল বাড়াতে হবে, ট্রাফিক ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হবে এবং নাগরিকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।
সমাধানের পথ কী হতে পারে?
১. ট্রাফিক ব্যবস্থার সংস্কার: নবীনগর সংলগ্ন মহাসড়ক ও অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলোতে গতিসীমা নির্ধারণ, স্পিড ব্রেকার, এবং ট্রাফিক ক্যামেরা বসানো জরুরি।
-
সচেতনতা ও গণসংযোগ: জনগণকে সচেতন করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। ডিজিএফআই বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে কেউ আসলে তার পরিচয় যাচাই করার জন্য জনগণকে পরামর্শ দিতে হবে।
-
পুলিশি টহল বৃদ্ধি: বিশেষ করে রাতে পুলিশের টহল বাড়ানো এবং দোকানপাট ও আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
-
আইনের কঠোর প্রয়োগ: যেকোনো অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত এবং বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপরাধীরা সাহস না পায়।
নবীনগর, একটি সম্ভাবনাময় জনপদ, বর্তমানে নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অপহরণ, দুর্ঘটনা ও চুরির মতো ঘটনা কেবল একটি এলাকার নয়, একটি দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতিফলন। সময় এসেছে, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও সাধারণ মানুষ সবাই মিলে একটি নিরাপদ নবীনগর গড়ার জন্য একসঙ্গে কাজ করার।