নবীণগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, [১৭ এপ্রিল ২০২৫ ]: ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। স্থানীয় ভূমিদস্যু রিপন মিয়া একের পর এক জমি দখল, মিথ্যা মামলা এবং সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে, সাবেক মেম্বার জনাব মুখলেছুর রহমানের ভোগান্তি স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আরও একবার সামনে নিয়ে এসেছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, রিপন মিয়া নোয়াগাঁও ও আশেপাশের গ্রামগুলোতে দীর্ঘকাল ধরে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে আসছে। তার মূল হাতিয়ার হলো পেশীশক্তি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্থানীয় প্রশাসনের একাংশের যোগসাজশ। নিরীহ ও দুর্বল মানুষদের জমি দখল করা, তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা এবং নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
ভুক্তভোগী মুখলেছুর রহমান, যিনি নোয়াগাঁওয়ের সাবেক মেম্বার রিপন মিয়ার দ্বারা সংঘটিত জমি দখলের সবচেয়ে বড় শিকারদের একজন। ৯০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ জানান, তার জীবনে তিনি এমন অন্যায় ও বিচারহীনতা আর কখনো দেখেননি।
মুখলেছুর রহমানের অভিযোগ অনুযায়ী, রিপন মিয়া প্রথমে গ্রামের ৬৫ বিঘা জমি দখলের চেষ্টা করে। আপসের কথা বলে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভুয়া দলিল দেখিয়ে জমিটি দখল করে নেয়। মুখলেছুর রহমান এর প্রতিবাদ করলে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। এরপর রিপন মিয়া তার নিজের এবং তার ভাই ও ভাতিজাদের মালিকানাধীন ২৫ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে আদালতে মামলা চালানোর পরেও, মুখলেছুর রহমান এবং তার পরিবার তাদের জমিতে দখল ফিরে পাননি। রিপন মিয়ার সন্ত্রাসী বাহিনী এবং একের পর এক মিথ্যা মামলার কারণে তারা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
মুখলেছুর রহমান বলেন, “আমার বাপ-দাদার আমল থেকে ভোগদখলে থাকা জমি গুলো কেড়ে নিয়েছে রিপন। আমি গরীব মানুষ, কোথায় গিয়ে এর বিচার চাইবো? আইনের কাছে গিয়েও কোনো ফল পাইনি। এই বয়সে আমি নিজের গ্রামের বাজারে পর্যন্ত যেতে পারি না অসুস্থতার জন্য, অথচ রিপন আমার নামে ঢাকা সহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একাধিক হত্যা মামলায় আসামি করেছে। এ বয়সে এসে আমাকে এতোগুলা মিথ্যা মামলার বোঝা বইতে হচ্ছে শুধু মাত্র নিজেদের জমি রক্ষার প্রতিবাদ করাই।”
রিপন মিয়ার সাম্রাজ্য:
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রিপন মিয়া ২০১৪ সালে এলাকায় এসে রাজনৈতিক নেতাদের হাত ধরে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। নাটঘর, নারুই, নোয়াগাঁও, নসরাবাড়ী, শিবনগর সহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে সে একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলে। এই বাহিনী বিচার শালিসের নামে রিপনের ‘ঝাড়ুদিঘি আদালত’-এ মানুষকে ধরে এনে জরিমানা করে লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করে।
যারা এই অবৈধ আদালতের ফতোয়া মানতে রাজি হয় না, তাদের ওপর নেমে আসে নির্মম অত্যাচার। জরিমানার সম্পূর্ণ টাকা দিতে না পারলে তাদের গরু-বাছুর ধরে নিয়ে রিপনের খামারে আটকে রাখা হয় এবং পরে সেগুলো বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে বা আইনি প্রতিকার চাইতে গেলে তাকে মিথ্যা মামলার জালে ফাঁসানো হয় অথবা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।
রিপন মিয়ার এই অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে অনেকেই ভয় পান। তার নিজস্ব বাহিনী এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের সাথে যোগসাজশের কারণে সাধারণ মানুষ অসহায় জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়।
আইন ও প্রশাসনের নীরবতা:
মুখলেছুর রহমান এবং অন্যান্য ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, স্থানীয় প্রশাসন রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা নীরব থাকেন। কিছু ক্ষেত্রে, তারা রিপনের পক্ষ নিয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ উপেক্ষা করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আইন ও প্রশাসনের এই নীরবতা রিপন মিয়ার মতো ভূমিদস্যুদের আরও বেপরোয়া করে তোলে। তারা মনে করে, তাদের অপকর্মের কোনো বিচার হবে না এবং তারা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে।
এই ঘটনার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
- রাজনৈতিক প্রভাব: রিপন মিয়ার রাজনৈতিক দলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যা তাকে স্থানীয় প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করতে সাহায্য করে।
- অর্থনৈতিক ক্ষমতা: বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ায় রিপন মিয়া সহজেই স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাবিত করতে পারে।
- দুর্বল আইনি ব্যবস্থা: বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতা এবং জটিলতার কারণে ভুক্তভোগীরা দ্রুত ন্যায়বিচার পান না। এই সুযোগটি ভূমিদস্যুরা কাজে লাগায়।
- প্রশাসনের দুর্নীতি: স্থানীয় প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা রিপন মিয়ার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে তার অপকর্মে সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
- সাক্ষীর অভাব: রিপন মিয়ার ভয়ে অনেকেই তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সাহস পান না, যার কারণে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়।
ভুক্তভোগীদের বর্তমান অবস্থা:
রিপন মিয়ার অত্যাচারে জর্জরিত মুখলেছুর রহমান এবং অন্যান্য ভুক্তভোগীরা চরম অসহায় জীবন যাপন করছেন। তারা একদিকে যেমন তাদের জমি হারিয়েছেন, তেমনি অন্যদিকে মিথ্যা মামলা এবং সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে সর্বদা আতঙ্কিত থাকেন। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে এবং তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
মুখলেছুর রহমানের মতো অনেক বৃদ্ধ এবং দুর্বল মানুষ, যাদের আইনি লড়াই করার মতো শারীরিক ও মানসিক শক্তি নেই, তারা রিপনের দাপটে নিজেদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান:
এই পরিস্থিতিতে দ্রুত হস্তক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা জরুরি:
- অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার: প্রশাসনকে অবিলম্বে রিপন মিয়াকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করতে হবে। তার অপকর্মের জন্য তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন অপরাধ করার সাহস না পায়।
- জমি পুনরুদ্ধার: দখলকৃত জমি দ্রুত মুখলেছুর রহমান ও অন্যান্য ভুক্তভোগীদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে, সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
- নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারকে নিরাপত্তা প্রদান করা জরুরি। রিপন মিয়া এবং তার বাহিনীর দ্বারা কোনো প্রকার হয়রানি বা হামলার শিকার হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
- আইনি সহায়তা কেন্দ্র: দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য স্থানীয় আইনি সহায়তা কেন্দ্রগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। সেখানে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ এবং প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- সাক্ষী সুরক্ষা আইন: সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা জরুরি। এই আইন ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
- প্রশাসনের জবাবদিহিতা: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনের মধ্যে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের কার্যক্রমের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- ভূমি সংস্কার: ভূমি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করতে এবং ভূমিদস্যুতা প্রতিরোধে একটি ব্যাপক ভূমি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। জমির মালিকানার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থা চালু করা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: ভূমিদস্যুতা এবং এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গণমাধ্যম, স্থানীয় সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা:
গণমাধ্যমকে এই ঘটনাটি জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে এবং প্রশাসনের ওপর দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে ঘটনার গভীরে গিয়ে আসল সত্য উদঘাটন এবং রিপনের অপকর্ম ও তার পেছনের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
এই ধরনের ঘটনাগুলি সমাজের দুর্বল ও অসহায় মানুষদের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়। গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষভাবে এই ঘটনার প্রতিটি দিক তুলে ধরতে হবে এবং ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
নোয়াগাঁওয়ের এই ঘটনা স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা, আইনি ব্যবস্থার ত্রুটি এবং সমাজের প্রভাবশালী মহলের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি চরম উদাহরণ। এই ঘটনার দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান হওয়া উচিত।